আজ সমুদ্রে কোন ঢেউ নেই। শুধু হাল্কা বাতাস । যথেষ্ট রোদেও বেশঠাণ্ডা লাগছে। জ্যাকেট আনা উচিত ছিল। আনা হয়নি।
উচিত আরও অনেক কিছুই ছিল।
দুটো মেয়ে সাগরের তীর ধরে দৌড়চ্ছে। শর্টস, টিশার্ট আর রানিং সু। প্রতিটা পদক্ষেপে হাত আর পা’এর মেদহীন কিন্তু কোমল পেশীগুলো কত প্রাণময়,কত দ্বিধাহীন ।
হায়দ্বিধা!
প্রতিদিন স্রোতে ভেসে আসে সামুদ্রিক গুল্ম আর গাছের সরু ডাল। একটু সন্ধ্যা হলেই অনেকে শুকনো ডালগুলো জড়ো করে আগুন ধরায়। তারপর ঘিরে বসে।পিকনিক বাস্কেট থেকে বের করে স্যান্ডুইচ আর পানীয়। ধোঁয়া গুলো হাল্কা হতে হতে স্বাধীনভাবে মিশে যায় আকাশে। আহা কী আনন্দ, আগুনেরও মানুষেরও।
‘স্যামি...’ কে একজন ডাকল। তুলতুলে ফুরফুরে বিশন ফ্রাইজতা ছোট একটা গাছের ডাল মুখে নিয়ে ছুটে এলো সত্ত্বাধিকারীর কাছে। গাঁট্টাগোট্টা সানগ্লাস পড়া লোকটা ডালটা আবার পানিতে ছুঁড়ে মারল। কুকুরটা স্পঞ্জ বলের মত সেদিকে ধে’ গেলো। এভাবেই চলবে কতক্ষণ, এক সময় স্যামি ক্লান্ত হবে, ওরা ফিরে যাবে।
সেই সতের বছর বয়সে বিয়ে। সেও কী বার বার এই গাছের ডালই কামড়ে এনে দিচ্ছে না তেইশ বছর ধরে?
রাজ্যের অবসাদ আর ক্লান্তি ওকে ভর করে।
না, এখন ফেরা দরকার। একটু দেরী হলেই শুরু হয়ে যাবে।কেন দেরী হলো , কোথায় দেরী হলো, কার সাথে?
****
‘আর একটু আগে আসা যায় না? নাও, ওকে ধরো, ন্যাপি লিক করেছে, আমি ঘুমব ।’
জসীম উপরের ঘরে ঘুমুতে চলে গেলো। ওর বৈকালিক ঘুম। টিভিটা বন্ধ করে গেলেই হতো। হিন্দি মুভির হাত থেকে ইহকালে মুক্তি নাই। অসহ্য।অসহ্য। অসহ্য।
ফ্রিজে খাবার ছিল। এখন অদৃশ্য।
‘জসীম, কাবাব আর রুটির বক্স দুটো কোথায়?’ সিঁড়ির কাছে এসে উপড়ে মুখ বাড়িয়ে জানতে চাইলো বিন্দু।
‘শেষ হয়ে গেছে, সিঙ্কে দ্যাখো’।
সিঙ্কে কী দেখব? আধোয়া খালি বক্স? ওকে এসে যে কিছু একটা খেতে হবে সে বোধ জসীমের নেই।অথবা ওর এসে যায় না।
যে চার দিন আজ্ঞে হুজুর কাজে যান, ও বাচ্চাকে দেখে, ঘর পরিষ্কার করে, খাবার রান্না করে। অন্তত দুটি মাংস আর একটা মাছের তরকারী ছাড়া এই মহান ভদ্রলোকের কোন ভাবেই চলেনা। খাবার বাসী হলে কিংবা পান থেকে কোন চুন খসলে খবর।
চুন খসা, কালি লেপা সব ওর বেলায়।
বিন্দু হঠাৎ টের পেলো মিলির বডিস্যুট ভেজা। সকালে কখনো ফিডার থেকে দুধ পড়েছে। সারাদিন মেয়েটি সেই জামাই পড়ে আছে। মহান ভদ্রলোক জামাটা বদলে দেবারও প্রয়োজন বোধ করেন নি।
বিন্দু অবসন্ন শরীর সোফায় এলিয়ে দিলো। আজকাল আর চোখ আর্দ্র হয় না। রিসার্ভার ফুরিয়ে গেছে।
****
সায়মনের জীবনে বলতে গেলে কোন ঘটনাই নেই।ঘটনা নেই বলা ভুল হলো। কাহিনী অনেকই আছে কিন্তু মোচড় কোথায়? ব্যাপক জটিলতা আর মোচড়ের উপরে মোচড়। তাতেই না বৈচিত্র্য।
দু বছর আগের কথা। এক সন্ধ্যায় ক্রিসমাস শপিং সেরে ওয়েস্ট এন্ড-এ হাঁটছে। ছাত্র বিক্ষোভ চলছে। হঠাৎ একটা রোলস রয়েস গাড়ির উপর অনেকে হামলে পড়ল। ও অভ্যাস বশে গাড়ির ভেতরের বুড়াবুড়িকে রক্ষার চেষ্টা করল। পুলিশও চলে এলো অতি দ্রুত। পরদিন সকালের পত্রিকায় দেখল গাড়িতে ছিলেন প্রিন্স চার্লস আর ক্যামিলা। ছবির ফ্রেমে ওর একটা হাত দেখা যাচ্ছে। সায়মন খবর হয়েও হলো না।
এই শীতে রোমানিয়ার স্কী রিসোর্টে গ্যালো। সাথ সোফি। যেদিন ফিরে এলো তার ঠিক পরদিন ওখানেই তুষারধ্বস । চার জন অ্যামেরিকান ধরাশায়ী। ঘটনাটা যেন ইচ্ছে করেই পরে ঘটলো।
সোফি কিশোর কালের প্রিয়তমা। আর সবার মেয়ে-বন্ধু পাঁচ ছ’ বার বদল হয়ে গেছে। ওর আজও সেই সোফি। কে যেন সুপার গ্লু দিয়ে ওদের মন দুটি জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। অক্ষত ভাবে আলাদা করা অসম্ভব।জীবনটা যেন একটু আগে থেকেই বেশী সুখী আর বেশী স্থিত।
বাবা সার্কাসের রোপ-ওয়াকার। সব সময় হাসিখুশি। এই পর্যটন শহরে সারা বছর উৎসব লেগেই আছে। রোজগার যথেষ্ট। কিন্তু পকেটে পয়সা থাকে না। প্রায়ই একথা সে কথা বলে বন্ধুরা টাকা ধার নেয়। সেই ধার ধারই থেকে যায়। ধার শোধের ধার আর কেউ ধারে না। লোকে বলে উনি অতি সরল বলেই ওনার কাজ নাকি সরল রেখার ওপর দিয়ে হাঁটা।
সংসারটা ধরে রেখেছে সায়মনের মা। ক্লার্ক হিসেবে ব্যাংকে যোগ দিয়েছিলেন। ধার্মিক, সৎ এবং পরিশ্রমী। বিশ বছর পর সেই ব্যাংকেরই স্থানীয় ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।পেছন দিয়ে গিট্টূ মারা ওনার অত্যন্ত অপছন্দ। যাকে যা বলার সরাসরি বলেন।
এই সরলতার জন্য না কী ওরা আইরিশ সেই জন্য, সায়মনের পরিবারকে সবাই আড়ালে আড়ালে বলে বেকুব-পরিবার।
****
বিন্দু তিনটা পাঁচশো মিলিগ্রাম ঘুমের বড়ি খেয়ে বিছানায় গেছে। সন্ধ্যা থেকেই প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। খুব ভোরে কাজ।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো। মহান ভদ্রলোক জোরে ধাক্কা দিচ্ছেন। ঘুম না ভাঙ্গিয়ে ছাড়বেন না। তার প্রাপ্য তিনি বুঝে নেবেন।
কখনো বিন্দুর কিছু হলো কিনা সে বিবেচনা কোনদিনও করেননি। পরিতৃপ্তি যেন একটা এক পাক্ষিক ব্যাপার।
বিন্দু কাঠ হয়ে রইলো।
সব শেষ করে মহান ভদ্রলোক বিন্দুর দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
বিন্দুর আজ আর সারা রাত জেগে কাটবে।ভোরে কাজ।
****
সায়মনের মা’র একটাই সমস্যা। উনি খেতে ভীষণ ভালবাসেন। বীফ কারী, চিকেন কারী, পিলাও রাইস, মাটন রোল, সালামী, ডোনার কাবাব, বার্গার, তিরামিসু, ফালাফাল। প্রাচ্যের খাবার, পাশ্চাত্যের খাবার। আহারে আহা, ঈশ্বরের দুনিয়ার এতো খাদ্যখানা।
খাবারের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা না থাকলে এই সন্ধ্যাটা ওনার ঘরেই কাটত। হাসপাতালের লোহার খাটে বসে আসন্ন অপারেশনের কথা ভাবতে হতো না।
উনি অবশ্য অপারেশনের কথা ভাবছেন না। ভাবছেন, যদি খারাপ কিছু ঘটে তাহলে ওনার ছেলেটার কী হবে?
মহান সৃষ্টিকর্তা কম করে হলেও তিনশো বছর আগের এক মানুষকে তার গর্ভে দিয়েছেন। বোকাসোকা, সরল সোজা। এই নতুন দুনিয়ার হাল হকিকত সে কিছুই বোঝে না।এখন পর্যন্ত তার এই ছেলে কোনদিন মিথ্যা কথা বলেনি। বেয়াদবি করেনি। কখনই শনিবার রাতে মাতাল হয়ে ঘরে ফেরেনি।
একদিন সায়মনকে দুধ কিনতে পাঠিয়েছেন।জানালা দিয়ে দেখেন মোড়ের দোকানের সামনে জটলা।লম্বা স্বাস্থ্যবান তার এই ছেলে। রোগাভোগা মাঝারী গড়নের দুই অকালকুষ্মাণ্ড ওকে ধরে টানাটানি করছে। সে ঠায় দাঁড়িয়ে।উনি দৌড়ে বাইরে আসতেই ছেলেগুলো দ্রুত সটকে গেলো। সায়মনকে জিগ্যেস করলেন ‘তুই অমন চুপ করে মার খেলি? পাল্টা দিলি না কেন?’ সায়মন গম্ভীর হয়ে বলল ‘মা, আমি তো ওদের মত না’। বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো।
তার এই নাফেরেশতা-না মানুষ ছেলে কখন যে কার খপ্পরে পড়ে।
উনি না দেখলে সেটা আর কে দেখবে? সোফি দেখবে তো?
****
হারমোনিয়ামটা এনেছিলেন বিন্দুর বড় মামা । সাউথল থেকে। তিন বছর ধরে স্টোরেই পড়ে আছে।এই রোববার ও হারমোনিয়ামটা ঝেড়ে মুছে আবার নূতন করে ফেললো।
বিয়ের আগে ওর কণ্ঠে একটা গান জসীম খুব শুনত ‘সকলি ফুরল স্বপন প্রায়’। বিয়ের পর সব যেন ওই স্বপ্নের মতই ফুরিয়ে গেলো।মহান ভদ্রলোক আর কখনই ওর গান শুনতে চাননি। ভদ্রলোকের সযত্ন-চর্চিত সংগীত-মনস্ক ভাবটি হঠাৎ কর্পূরের মতোই উবে গেলো।
বিন্দু প্রথম প্রথম খুব আহত বোধ করেছে। ঠিক করেছিল ও না বললে আর কখনই গাইবে না। এতো বছর পর মনে হলো যে প্রতিভা জসীম দেয়নি জসীমের উপর অভিমান করে তা নষ্ট করার কি মানে।
বিকেলে কাজ থেকে এসে ভেবেছিল আধ ঘণ্টার জন্যে হলেও হারমোনিয়াম নিয়ে বসবে। সেই গানটি দিয়ে শুরু করবে ‘সকলি ফুরল স্বপন প্রায়’।
কিন্তু টেবিলের উপর তো কিছুই নেই।এতো বড় যন্ত্র যাবে কোথায়?
‘জসীম, হারমোনিয়ামটা দেখেছ’
‘হ্যাঁ, থ্যাংকস, আমি বলার আগেই পরিষ্কার করে রেখেছ’।
‘মানে’
‘অফিস পার্টিতে কাল নূতন মেয়েটা গাইলো। দারুণ গলা। কলকাতার। বললো সুমিত্রা সেনের মেয়ে শ্রাবণী সেনের কাছে দু বছর গান শিখেছে। এনিওয়ে, এদের কাউকেই আমি চিনি না।’।
‘আমার হারমোনিয়ামটা কোথায়?’
‘ওকে আজ দিয়ে আসলাম। এই বাসায় তো আর আমরা কেউ গান করি না।জিনিসটা একটা প্রপার কাজে লাগবে’।
বিন্দুর মুখ আর কান লাল হয়ে গেলো। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
****
ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর থেকেই মনটা অস্থির লাগছিল। মা ডায়াবেটিক। ওপেন হার্ট সার্জারিতে জটিলতা দেখা দিতে পারে। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, রক্ত ক্ষরণ, এমনকি ভাগ্য খারাপ হলে মৃত্যু। আবার কিছু না ও হতে পারে। ফিফটি ফিফটি।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই সায়মন গির্জায় ছুটলো।
বেদীর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। তারপর মনে মনে বললো ‘হে সুমহান পিতা, ধুলোর মানুষ ধূলায় মেশে, সেতো অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আমার মা সারা জীবন এতো পরিশ্রম করলেন, ওনার সুখের সময় সবে শুরু।আগামী বছর রিটায়ারমেন্ট। ওনার কত পরিকল্পনা, কত স্বপ্ন। এখনই যেন খারাপ কিছু না ঘটে।মা’কে অনুগ্রহ করুন হে মহান পিতা।আর যদি কিছু ঘটেও, মা’র পরিবর্তে আমাকে নিন।’
****
বিন্দু আয়নায় তাকিয়ে আছে। শরীরের দাগ গুলো হয়তো কাপড়ে ঢাকা পড়বে। কিন্তু মুখ?
এই চেহারা নিয়ে কাজে যাওয়া যাবে না। সবাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকাবে। মুখে কিছুই বলবে না। খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি হবে।
আজ ভোরে উঠেই ভদ্রলোক গোছলে গেলেন। নূতন পরিচ্ছন্নতা বোধ। টেবিলে ওনার ল্যাপটপ খোলা। ফেসবুকে একটা মেসেজ জ্বল জ্বল করছে।
বিন্দু আগ্রহ দমাতে পারেনি। বিছানা থেকে উঠেই মেসেজে চাপ দিয়েছে। ‘আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি। অফিস শুরুর আগেই এসো। হয়ে যাবে এক প্রস্থ’।
প্রেরিকার প্রোফাইলে চাপ দেবে, ঠিক সেই সময় ভদ্রলোক বাথরুম থেকে বের হলেন। কী একটা অনুমান করে পাগলের মতো বিন্দুর উপর ঝাঁপিয়ে পরলেন।
ভদ্রলোকের ব্যবহার দিন দিন কদর্য রূপ নিচ্ছে। একটা সীমা আজ অতিক্রান্ত হলো। একটা নাজুক সীমা । এখন আর কোনই আড়াল নেই।
সম্পর্কের হারিয়ে যাওয়া স্বাভাবিকতায় আর ফেরা যাবে কী?
বিন্দু ওর ডায়রি নিয়ে বসলো।
****
সফল অপারেশন।কণামাত্র জটিলতা হয়নি। রিকভারী খুব দ্রুতই হলো।
মাকে আজ হাসপাতাল থেকে আনা হবে। নূতন কেনা গাড়িতে। সায়মন রীতিমত গর্ব বোধ করছে।
এই মঙ্গলবার ড্রাইভিং পাস করেছে। ম্যানুয়াল গিয়ারে। কিন্ত গাড়িটা অটো । চার বছরের পুরনো। মাইলেজ খুবই কম। অকশনে পনের শ’ পাউন্ড। শো রুমে গেলে কম করে হলেও তিন হাজার লাগতো।
একটু বুঝে চালাতে হচ্ছে। ক্লাচ নেই। তবু প্রায়ই ক্লাচের ওখানে পা’ চলে যায়। কাল পরশুর ভেতর অভ্যাস হয়ে যাবে।
হাসপাতালের কার পার্ক বহুতল। র্যা ম্প মুডে আস্তে ধীরে গাড়ী চারতলায় উঠে এসেছে। অটো গিয়ারের এটাই সুবিধা।
আধ ঘণ্টা পর মা’র ফোন এলো। ওরা নীচে ইমারজেন্সী গেটের সামনে অপেক্ষা করছে।
সায়মন শিস দিতে দিতে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গিয়ার চেঞ্জ করল। তারপর জোরে এক্সেলেটরে পা রাখল।
কিছু বোঝার আগেই গাড়িটা রেলিং এর দিকে ছুটে যাচ্ছে। রিভার্স গিয়ারে।
****
রাস্তার ও পাশ দিয়ে মধ্যবয়সী নার্স যাচ্ছিলেন।বিকট শব্দ শুনে তিনিই প্রথম উপরে তাকালেন। চার তলার এক কোনে লোহার রেলিং ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে গেছে আর রুপালী রঙ এর ফিয়াট গাড়ীটা দ্রত নীচে পড়ছে।
তারপর ঠিক নীচে তাকালেন। দীর্ঘাঙ্গিনী রূপসী এক এশিয়ান মহিলা নিবিষ্ট মনে হাঁটছে। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই।
জীবনে প্রথম ও শেষবারের মত সায়মন কোন ঘটনার কিম্বা দুর্ঘটনার কেন্দ্র হতে যাচ্ছে।
****
জসীমের হাতে বিন্দুর পত্রগুচ্ছ অথবা ডায়রী । অসমাপ্ত।পুলিশ একটু আগে বিন্দুর হ্যান্ড ব্যাগ দিয়ে গেছে। ওর ভেতরেই ছিল।
বিন্দুর একটানাকি দুর্ঘটনা হয়েছে।রাস্তা মাঝ দিয়ে বোকার মতো হাঁটলে ও রকম হবেই। যত্তসব। ঝামেলার উপরে ঝামেলা।
হাসপাতালের ঠিকানা রেখে গেছে। যা হোক সেটা পরে দেখা যাবে।আগে দেখা দরকার এখানে কী লেখা। ওর নামে খারাপ কিছু লেখেনি তো? নীলার কথা কতটুকু জানে?
জসীমের ভ্রূ কুঁচকে গেলো।সতর্ক মুখে লেখার ভেতর ডুবে গেলেন।
২৮।০৮।১২
অনেক দিন ধরে ভাবছি মনের কথাগুলো লিখব। মুখে তো আর গুছিয়ে বলা হবে না। সামনা সামনি তুমি এতই তাচ্ছিল্য করো, নিজেকে খুব হীন মনে হয়। কেঁচোর মত কুঁকড়ে যাই।
মানুষের আত্মসম্মানবোধ তুমি খুব সহজে ধূলিসাৎ করে দিতে পারো। এমন তির্যক প্রতিভা ক’জনের থাকে?
একদিন এই ডায়রী তোমাকে দেবো। এটাই তোমার কাছে আমার শেষ পত্রগুচ্ছ।
অথবা তোমার ভাষায় ‘ফালতু’।
৩০।০৮।১২
প্রথম প্রথম ভাবলাম তুমি বদলে যাচ্ছ। পড়ে বুঝলাম এ ধারনা ভুল। এটাই পূর্ণাংগ তুমি। তোমার চকচকে মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে।
দেশে থাকতে এতোটা বেশী সময় আমরা নিজেদের মুখোমুখি হইনি।
ঘরে রান্না করা, বাজার করার মানুষ ছিল। কাজের চাপ মোটামুটি। কিন্তু ব্যস্ততা ভীষণ। আজ খালার মেয়ের বিয়ে, কাল ভাবীর জন্মদিন, পরশু আপার সিজারিয়ান, শনিবার পিকনিক। আলগা ব্যস্ততা।
জীবনটা ভর-ভরন্ত। কী দিয়ে ভরা সেটা দেখবার সময় কই? তুমিই কী আমাকে ভালো করে দেখতে পেয়েছ কিম্বা আমি তোমাকে?
০২/০৯/২০১২
বিদেশে এসে জীবনটা কিন্তু অনেক বেশী সরল হয়ে গেলো। একের পর এক সামাজিকতা আর ঘটনার ঘনঘটার পেছনে নিজেকে আড়াল করার উপায় খুবই কম। কিছুটা আড়ালই হয়তো ভালো।
একটা ঘটনা মনে পড়ে।
আব্বুদের সামনের বাসায় বিহারী পরিবার। ওরা সব সময় আমাদের বাড়ী আসতো, আমরাও নাকি যে কোন সময় ওদের বাড়ী যেতাম। ঘরে চিনি কিম্বা চা পাতা বা অন্য কিছুর টান পড়লে ওদের ওখান থেকে নিয়ে আসা হতো। এক সময় ফেরত দিলেই হলো। ওরাও তাই। এদিকে খাতির সেদিকে খাতির। এমনকি ছোট খালার জন্য আব্বু নাকি ওদের বড় ছেলের কথা ভাবছিল।
একাত্তরের যুদ্ধ একটা ভোজবাজি ঘটিয়ে দিলো। বিহারী ভদ্রলোক একদিন চাচাকে নিয়ে বের হলেন। চাচা আর ফিরে আসেন নি। পরে জানলাম ডিসেম্বরের আগে আগে তিনি অনেককে নিয়েই এমন বেরিয়েছেন। কেউই ফিরে আসেনি।
যদি যুদ্ধ না হতো? আমরা দুটো সুন্দর পরিবার চিরকাল মহানন্দে পাশাপাশি কাটিয়ে দিতাম। তোমরা ভালো, আমরা ভালো, সবাই ভালো।ধারালো নখগুলো থাবার ভেতর বোজা।
যদি দেশে থাকতাম, হয়তো ভালই থাকতাম তুমি আর আমি। অনেক ছোটোখাটো অসঙ্গতি আগেও চোখে পড়েছে, কিন্তুতোমার এই ভয়ঙ্কর অন্য চেহারা দেখতে হতো না।
০৫/০৯/২০১২
মহাশূন্যে নাকি যে কোন বিন্দুই কেন্দ্র। কারন যে কোন বিন্দুরই পরিধি অসীম। আমি ভাবি যে মানুষ মহৎ তার হৃদয়ে সব মানুষই কেন্দ্র। কারন মহৎ মানুষের হৃদয় মহাশূন্যের মতই অসীম। সেই গানটার মত ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী শর্তে’।
কিন্তু আমাদের পরিবার তা নয়। এখানে তুমি কেন্দ্র আর বাকিরাকৃত্রিম উপগ্রহ। তুমি রাজা,আমি আর আমার মেয়েটা প্রজারও অধম। তোমার উত্থানে সবার উত্থান তোমার পতনে সবার পতন।
অন্তত তুমি তা’ই ভাব।
০৮/০৯/২০১২
আর কত বছর বাঁচব? বিশ বছর? পঁচিশ বছর? এই বিশটা বছর আমি একটা জীবন চাই।আমার নিজের জীবন।
সম্ভাবনা বলে তো আর কিছু অবশিষ্ট নেই। শুধু সমাপ্তিটা যেন অর্থপূর্ণ করা যায়।
সব সময় ভেবেছি মানুষের জন্য একটা কিছু করব। হয়তো সব মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীরাই একটা বয়সে এমন ভাবে। আর এই যে ভেবেছিল সেটা রোমন্থন করেই বিশেষপরিতৃপ্তি বোধ করে।
আমার ভাবনাটাও ভাসা ভাসা। কিন্তু এর পেছনে আবেগ ও নিষ্ঠা দুটোই সুগভীর এবং প্রবল।
জুলি কী কখনো তোমাকে বলেছে ?
ওরা ময়মনসিংহে একটা প্রজেক্ট শুরু করবে। পরিবেশ বান্ধব সাশ্রয়ী বাড়ী । ভুমিহীন আর নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য। ডিএফআইডি’র গ্র্যান্ট পেয়েছে। তিন বছরের প্রজেক্ট ।
জুলি কেমন মেয়ে তুমিও জানো। কেইমব্রিজের স্নাতক। স্ট্রাকচারাল এঞ্জিনিয়ারিং-এ। এতো মেধাবী, কিন্তু কখনো বড় কোম্পানির চাকুরী করেনি । মাল্টি–ন্যাশনাল কোম্পানির কাজ মানেইতো নিজের অজান্তেই নিজেকে বিকিয়ে দেয়া। কোথাও না কোথাও নীতির সঙ্গে আপোষ।
জুলি নিজের জন্য ঘর বাড়ি কিছুই করেনি। একটা বোটে থাকে। টেমস নদীর পারে। শীতে যখন বরফ পরে তখন ওর অনেক ঝামেলা হয়। টাকা-পয়সার মোহ নাই। আকশে কার্বন বাড়বে বলে গাড়ী চালায় না।পুঁজিবাদের অন্ধকার দিকগুলো ওকে ভাবায়। এখনোপৃথিবী বদলে দেবার স্বপ্ন দ্যাখে। ওকে নব্য-পুজিবাদী বা বেনিয়া বলে উড়িয়ে দেবার কোন উপায় নেই।
জুলি আমাকে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে চাচ্ছে।আমার বাংলাদেশে!আমারই শহরে!
মুখে বলেছি ভেবে দেখব। সিদ্ধান্তটা তখনই মনে মনে নিয়ে ফেলেছি।
১২/০৯/২০১২
নিজেকে ঘিরে সমৃদ্ধি হয়তো সম্ভব, কিন্তু শান্তি ?এই প্রশ্নটামাথায় আসতেও অর্ধেক জীবন কেটে গেলো।
বাকী সময়টা এর উত্তর খুঁজে বেড়াবো।
ব্যক্তিগতভাবে তুমি আমি বোধ হয় দুটো পৃথক দ্বীপ। এই দুই দ্বীপের মাঝে নির্বোধ যৌবন যে ব্রিজ রচনা করেছিল তার সব পাটাতন আর স্ক্রু একে একে খুলে পড়ছে।
সম্পর্ক তো একটা মেইন্টেন্যান্স, একে ঘষে মেজে ঠিক রাখতে হয়। এটা কোন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়-যেমনটা তুমি ভাব।
নীতিগতভাবেও আমাদের পথ আলাদা। তুমি সব সময় বৈষয়িক ঋদ্ধি চেয়েছ - যে কোন মুল্যে। আর আমি শান্তি।
১৪/০৯/২০১২
আর হ্যাঁ, নীলার কথা আমি জানি।সেদিনের পর থেকেই। এ বিষয়ে বেশী কিছু বলবার রুচি কিম্বা অভিপ্রায় কোনটাই আমার নেই।
আমি চল্লিশে পা দেবো। সামনে আমার মেনোপজ। আমার হরমোনাল চেঞ্জ হবে। মেয়েলি ভাবটা ধীর ধীরে কমবে। চাই বা না চাই একটা রুক্ষতা আসবে। সাথে যোগ হবে হট ফ্ল্যাশ্, মানসিক ক্লান্তি, হৃদয়ের আলো ম্লান করে দেয়ামুড সুইং।
নীলা চঞ্চল, উচ্ছল, অনেক বেশী বাস্তববাদী। ও মাত্র বাইশ! জৈবিকভাবে সুপ্রবল। চলমান চুম্বক।
রবীন্দ্রনাথের একটা গান মনে পড়ে ‘পুরানো জানিয়া চেওনা আমারে আধেক আঁখির কোনে, অলস অন্যমনে’। কিন্তু এ বাণীর সুক্ষ বেদনা তোমার বোধের অতীত।
যখন আমার প্রয়োজন সাহচর্য আর সহানুভূতি ঠিক তখনই তুমি আমাকে একটা অসম যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিলে।
এটা আমার প্রাপ্য ছিল না।
১৮/০৯/২০১২
ভেবে দেখলাম এমতবস্থায় তোমার জীবন থেকে সসম্মানে সরে আসাই ভালো।
জুলিকে জানিয়ে দিয়েছি আমি আগ্রহী। এই নভেম্বর থেকে কাজ শুরু। আহা, অবশেষে একটা নতুন জীবন। প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে কাজ। সত্যের সন্ধান, সমতার সন্ধান।
বাবাও খুব খুশী হবেন। উনি তো ময়মনসিংহে বলতে গেলে একাই।তার আদরের রাজকন্যাকে এতদিন পর কাছে পাবেন। মেয়ের কণ্ঠে আবার সেই আগের মতো হারানো দিনের গান শুনবেন।
বাবা আর মা’র খুব একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল। এ কারনেই আমাদের বাড়িটা ছিল একটা প্রার্থনা ঘরের মতো। ঝকঝকে, তকতকে, আলোয় আলোকময়।
মা’র মৃত্যুর পর বাবা আর বিয়ে করেন নি। এই সম্পর্কের শক্তি কোথায় ছিলো? গভীর ভালবাসায়? সচ্ছলতায়? ধর্মভয়ে?
না।সম্মানে । দুজন দুজনের বোধগুলোকে সম্মান করতেন। ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান’।
আমি ‘নাইইভ’ ছিলাম। ভেবেছিলাম সব স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কই হবে আমার বাবা-মার মতো। আসলে আমাদের পরিবারটাই ‘নাইইভ’-অনভিজ্ঞতার কারনে সরল।কেউই তোমাকে পরিমাপ করতে পারেনি।
তুমি সব সময় আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছ। সব সময় চেয়েছ আমার ভেতরহীনমন্যতা কাজ করুক।
এখন ভাবি এটা তোমার নিজের ইতিহাসের কারনেই। সম্মান শব্দের অর্থ বোধ করি সম পরিমান মান দেয়া। তুমি মনের গভীরে হয়তো নিজেকেও তেমন মান দিতে না, আমাকে কীভাবে দেবে?
২৫/০৯/২০১২
আমার গড়ন ছিল ইউরোপীয় মেয়েদের মতো। পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি। মুখের আদলটা সুচিত্রা সেনের। সবাই রাজকন্যা বলতো। আমি কখনো অহংকার বোধ করিনি। যিনি সৃষ্টি করেছেন এটা তার দক্ষতা।
আমার তখন ষোল।তুমিপঁচিশ। ভাইয়ার বন্ধু। সব সময় বাড়িতে আসা যাওয়া। আর পাঁচজন মানুষ থেকে আলাদা করবার মতো কিছুই কখনো চোখে পড়েনি। একটু বেশী খাটো আর সেগুন কাঠের মতো রং -সেটা বাহ্যিক।
তোমার চিঠি সব ওলটপালট করে দিলো। প্রকৃতির কী নিবিড় আর সংবেদনশীল বর্ণনা।সেই প্রকৃতির মাঝে প্রেমকে স্থাপন এবং উপস্থাপন করা। মনে হয়েছিল এই মানুষটার হৃদয়যেমনঘন তেমনি গভীর।এই মনের থই আর চমকখুঁজেই জীবনটা পার করে দেয়া যাবে।
তুমি আমাকে ‘তোমার সমগ্র জীবন দিয়ে’ চাইলে। আমি সম্মত হলাম। বাবা, এমন কী ভাইয়াও তেমন উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু মা-মরা মেয়েটা আহত হোক সেটা কেউই চায়নি। আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো।
বিবাহ শব্দের অর্থ হলো বিশেষভাবে বহন করা। দুজনের আনন্দের আর বেদনার ভার দুজনে একত্রে বহন ।
তুমিও বাবাকে কথা দিয়েছিলে বাড়ির এই ছোট মেয়েটাকে, এই মা-মরা মেয়েটাকে অনেকআদরে ও যত্নে রাখবে, তার সকল আনন্দ আর বেদনার ভার বহন করবে। বাবা আর ভাইয়ার মতো।
তোমার চিঠিগুলো পড়ার পর থেকে এ ব্যাপারে আমারও কোন দ্বিধা কিম্বা সন্দেহ ছিল না।
অনেক পরে জেনেছি চিঠিগুলো তুমি লেখোনি। আরেক বন্ধুর লেখা। কিন্ত সেই বন্ধুও নিজে লেখেনি, বুদ্ধদেব গুহ’র একটা উপন্যাস থেকে উঠিয়ে দিয়েছে। ‘চালিয়াতি’ শব্দটা খুব অরুচিকর। কিন্তু এ ছাড়া আর কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।
যাদের কাছে কথার কোনই মূল্য নাই তারা অতি সহজে কথা দিয়ে ফেলে।তুমিওতেমন দিয়েছিলে।সে কথারধূল-পরিমানমুল্যও রাখোনি।
****
জসীম একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো । নীলার ব্যাপারটা বিন্দু আঁচ করেছে। কিন্তু কোন হৈ চৈ বাঁধিয়ে বসেনি। সব কিছু যে এতো মসৃণ হবে ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। ভাগ্য বুদ্ধিমানদের সহায়।
বিন্দুকী সত্যি সত্যি দেশে যাচ্ছে? না কী ভাওতা দিলো?
বিন্দু’র বাবার দেয়া এপার্টমেন্টটা জসীমের নামে লেখা। এ ব্যাপারে ও তো কিছুই বললো না?এই মুহূর্তে প্রসঙ্গটা না ওঠানোই সুবিধাজনক।
বাচ্চাটারই বা কী হবে? আণ্ডাবাচ্চা জসীমের দুই চোখের বিষ। এই টয়লেট পরিষ্কার করো, এই ফিডার মুখে দাও। রাতে ক্যাচরম্যাচর।ইচ্ছে করে ছুঁড়ে বিছানা থেকে ফেলে দিতে। ঝামেলার পুটলিটাকেবিন্দুই নিক।
না কী ও রাখবে? চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট পাওয়া যাবে। ভালো পয়সা।
খুব সাবধানে খেলা দরকার। ঠাণ্ডা মাথায় কিন্তু নরমে গরমে। সবচে’ ভালো পরামর্শ দেবেনীলা।
জসীম টেলিফোনটা হাতে তুলে নিলো।
****
বিন্দুর চোখ বন্ধ।
ও সাগরের তীর ঘেঁষে দৌড়চ্ছে। শর্টস, টিশার্ট আর রানিং সু। প্রতিটা পদক্ষেপে হাত আর পা’এর মেদহীন কিন্তু কোমল পেশীগুলো কত প্রানময়, কত দ্বিধাহীন।
আর কি বাতাস! ও প্রানটা ভরেবাতাস নিচ্ছে।
ছোট মেয়েটা দূর থেকে কাঁদছে, মা, মা, মা।ওর এতো ছোট মেয়েটা।
হার্ট রেইট মনিটরে সবুজ রেখাটি দ্রুত ওঠানামা করছে। এএমন এক রেখা, যা কেউই চায় না সরল হয়ে যাক।